রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫০ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের পথ ধরেই শরিক জামায়াতে ইসলামীকে দূরে ঠেলতে চাইছে বিএনপি। দলটির একটি অংশের মধ্যে এ লক্ষ্যে জোর তৎপরতাও আছে। কিন্তু যেসব কারণে এক দশক ধরে জামায়াতকে দূরে সরানো যায়নি, সেই ইস্যুগুলো এখনো নিষ্পত্তি করতে পারেনি বিএনপি। তা ছাড়া জামায়াতও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়তে রাজি নয়। ফলে জামায়াত প্রশ্নে বিএনপি এখনো কিছুটা উভয়সংকটে রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে সব দলকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্য সামনে থাকায় জামায়াতকে রাখা না রাখা প্রশ্নে বিএনপিতে আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে। কারণ বাম ও উদারপন্থী দলগুলো জামায়াত থাকলে জোট গঠনে রাজি হবে না।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কৌশলী জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘শুধু জামায়াত নয়, জোট গঠনসহ বিভিন্ন প্রশ্নে বিএনপিতে এখন আলোচনা চলছে; কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। জামায়াত এখনো ২০ দলীয় জোটে আছে।’
গত ১ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জামায়াত ছাড়া ২০ দলীয় জোটের সব শরিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রধান শরিক ওই দলটিকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ শক্তি হিসেবে পৃথক করার পাশাপাশি দলটিকে এক ধরনের বার্তাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জামায়াত এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, বরং পৃথক উদ্যোগ নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের জন্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের কয়েক বছর আগ থেকেই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। তখন থেকেই আলোচনা ওঠে, জামায়াত সঙ্গে থাকার কারণে বহির্বিশ্বে বিএনপিবিরোধী প্রচারণা ব্যাপকতা পাচ্ছে। এ কারণে প্রধান প্রতিবেশী ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিএনপি সমর্থন হারাচ্ছে বলে তখন থেকেই বিএনপির ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে। তবে ভোট এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের হিসাব-নিকাশে শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে ছাড়তে পারেনি বিএনপি।
অবশ্য সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়া এবং দৃশ্যত বর্তমান সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘স্থিতিশীল’ সম্পর্কের কারণে জামায়াত প্রশ্নে বিএনপির ভেতরে চাপ বেড়েছে। বলা হচ্ছে, জামায়াত থাকলেও আন্দোলনে লাভ হচ্ছে না। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করে, সে বিষয়টিও জামায়াতকে ছেড়ে দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত বলেও কেউ কেউ মনে করেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দলটির স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ নেতা জামায়াত ছাড়ার প্রশ্নে মত দিয়েছেন বলে জানা যায়।
গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে দলটির স্থায়ী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠক পর্যালোচনা করে জানা যায়, মূলত তিনটি কারণে জামায়াতকে জোট থেকে বাইরে রাখার পক্ষে বিএনপি। প্রথমত, প্রধান প্রতিবেশী ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্বকে সন্তুষ্ট করা; দ্বিতীয়ত, বাম ও উদারপন্থী দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য করা এবং তৃতীয়ত, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে পরিচিত জামায়াতের সঙ্গে জড়িয়ে বিদ্যমান ‘অপপ্রচার’ থেকে বিএনপিকে রক্ষা করা।
সূত্র মতে, ওই তিনটি কারণের বিষয়ে দলের বেশির ভাগ নেতা একমত হলেও ভোটের রাজনীতি ও আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে আবার জামায়াতকে প্রয়োজন বলে কেউ কেউ মনে করেন। পাশাপাশি জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিএনপিকে কতটা সমর্থন করবে—এ নিয়েও দলটি নিশ্চিত হতে পারছে না। কারো কারো মতে, শক্তিশালী দু-একটি দেশের সমর্থন আওয়ামী লীগের প্রতি ‘ফিক্সড’ হয়ে গেছে। তাঁরা বলছেন, জামায়াতকে ছাড়লেও লাভ হবে না। আবার দেশের পরিস্থিতি কখন কী হয়, তা নিয়েও সাম্প্রতিককালে রাজনীতিতে নানামুখী আলোচনা আছে।
তবে জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকলে বাম ও উদারপন্থী দলগুলো বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যে আসবে না—এ ব্যাপারে দলটির প্রায় সব নেতা নিশ্চিত। আবার সবাইকে নিয়ে ঐক্য করলে সেখানে জামায়াতও একটি রাজনৈতিক শক্তি। ফলে তাকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য কী করে হয়, এমন আলোচনাও আছে। নবম সংসদে ৩৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জামায়াত শতকরা ৪.৭০ ভাগ ভোট পেয়েছে।
সূত্র মতে, বিএনপির ভেতরে নানামুখী এই বিশ্লেষণ ও মতের কারণে জামায়াত ছাড়ার প্রশ্নে দলটিতে কখনো চাপ বাড়ে আবার কখনো কমে। গত বছরের ১৮ জুলাই স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দীর্ঘ বক্তৃতায় বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবাইকে নিয়ে রাজনীতির (ইনক্লুসিভ পলিটিকস) কথা বলেন। ওই সময় জামায়াতকে ছাড়ার প্রশ্নে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন তিনি। তাঁর বক্তৃতার পর জামায়াতকে ছাড়ার আলোচনা বিএনপিতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর আগে দলটির সিনিয়র আরো পাঁচ নেতা জামায়াতকে জোটে না রাখার পক্ষে মত দেন। কিন্তু নীতিনির্ধারণী ওই প্রশ্নে সব শেষে মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতামত জানিয়ে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তিনি তা করেননি। অন্যদিকে আলোচনা হলেও তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া এ প্রশ্নে চূড়ান্ত মতামত দেননি বলে জানা যায়। তবে তাঁরা আলোচনা চালিয়ে যেতে বলেছেন। এমন পরিস্থিতিতেই ঝুলে আছে জামায়াত বিষয়টি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যেকোনো ইস্যুতে মহাসচিব হিসেবে নিয়মানুযায়ী সবার পরে আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। তা ছাড়া মহাসচিবের বক্তৃতার অর্থ পরোক্ষভাবে দলের সিদ্ধান্ত। সুতরাং সময় হলে আমি বক্তৃতা করব।’ তবে তিনি এ কথাও বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকেই কর্মসূচির ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির কিছুটা দূরত্ব আছে। আমরা আলাদা কর্মসূচি পালন করছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মতে, ‘জোট গঠন ও ভাঙা উভয় ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিতে সময়ের প্রয়োজন হয়। জামায়াতের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতেও সময় লাগছে।’ কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময় এবং বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বিএনপি তার কর্মকৌশল নির্ধারণ করবে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, বিতর্ক এড়াতে বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে দু-একটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
একটি সূত্রের দাবি, ২২ বছরের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে না চটিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে জোট থেকে আলাদা করার পক্ষে বিএনপি। এ জন্য গোপনে একজন নেতাকে দলটির সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম জানিয়েছেন, জোট ছাড়ার প্রশ্নে বিএনপির কোনো বার্তা তাঁদের কাছে নেই। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চাইলে জামায়াতও একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাই জামায়াতকে বাদ দিলে বৃহত্তর ঐক্য কী করে হয়?’
Leave a Reply